৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ২:৩৮
৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ২:৩৮

, ,

সম্প্রীতির পথে সাফল্যের অগ্রযাত্রা

  • তাপস হালদার

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মানের লক্ষ্যে ‘সম্প্রীতির পথে সাফল্যের অগ্রযাত্রা’ স্লোগানকে সামনে রেখে উত্তরবঙ্গের নাটোর জেলা থেকে যাত্রা শুরু করেছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

বিগত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’, ‘আমার ভোট আমি দেব, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে দিব’ শিরোনামে সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামে সামাজিক সংগঠনটি। বিগত দিনে প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আপোষহীনভাবে কাজ করেছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ। একটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য।

একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুবই প্রয়োজন। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক বিষয় নয়। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের মর্মকথা হল শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি। কিন্তু এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মকে হাতিয়ার করে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করে বারংবার দেশকে অশান্ত করেছে। যার শিকার হয়েছে অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ।

মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সেদিন কেউ প্রশ্ন করেনি- আপনি কোন ধর্মের বা বর্ণের মানুষ কিংবা আপনার পরিচয় কী? মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের রক্তের মিলিত স্রোতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সেদিন ঐক্যবন্ধ মন্ত্রই হয়ে উঠেছিল মুক্তিসংগ্রামের মূল শক্তি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করতেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে এবং ঘৃণা করতেন সাম্প্রদায়িকতাকে। এজন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে জাতীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন এবং সংবিধানের ২৮(১) ধারায় আরো সংযুক্ত করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র কখনোই তার নাগরিকদের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ ও জন্মস্থান ভেদে কোনো প্রকার বৈষম্য করবে না’। বঙ্গবন্ধু সকল জাতি, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সহাবস্থান ও সম-অধিকারের গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন,‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন-নীচ; তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।’

একাত্তরে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পর একাত্তরের পরাজয়ের নির্মম প্রতিশোধ নিতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো মরিয়া হয়ে উঠে। অবৈধভাবে জন্ম নেয়া তথাকথিত রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হলেও এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ীরা কখনো সরকারের সাথে থেকে রাষ্ট্রীয় মদতে আবার কখনো সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে সাম্প্রায়িক সংহিসতা ঘটিয়ে যাচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন শুরু করে। জোট সরকারের পুরো পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু নির্যাতন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছিল। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো ও সম্পদকে লুট করা, নারী-শিশুদের নির্যাতন, নিপীড়নকে ‘নিয়মিত উৎসবে’ পরিণত করেছিল। তারা ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান ঘটিয়ে, সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে সাম্প্রদায়িক উগ্রতাকেই বেছে নিয়েছিল। সেসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব ঘটনা ঘটলেও কেউ কোনো প্রতিকারে এগিয়ে আসেনি।

বর্তমান সরকার যেহেতু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সেহেতু উগ্রপন্থীরা চোরাগোপ্তা হামলাকে কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। ধর্মকে ইস্যু তৈরি করে নিরাপরাধ মানুষদেরকে ভিকটিম করে বারংবার সাম্প্রদায়িক সংহিসতা ঘটানো হয়েছে। কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের উপাসনালয়ে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, গাইবান্ধায় আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন, কুমিল্লার মন্দিরে হামলাসহ অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশের সম্প্রীতির ক্ষেত্রে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এসব ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না। যেখানেই ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে সেখানেই সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় এনেছে।

একটি দেশ কতটা ভালো আছে তা বোঝা যায় সেদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কতটা নিরাপদ আছে সেটা থেকে। কারণ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মত ঘটনা ঘটলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারায়, যা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়েও আরো বড় বিষয় হচ্ছে মানবাধিকার লংঘন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মারাত্মক নেতিবাচক বার্তা দেয়। সরকারকে বিব্রত করতে একটি গোষ্ঠী এ ধরনের ঘৃণিত কাজ বারবারই করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

আগামী নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই বিএনপি-জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো ধর্মের কার্ড সামনে নিয়ে আসবে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করবে, যা তারা প্রতিটি নির্বাচনের সময়ই করে থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু হওয়ার কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা এটিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়।

নাটোর সমাবেশে সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহবায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষ মোটেও সাম্প্রদায়িক নয়। অথচ এ পর্যন্ত যতগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে তার মূলে রয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা’।

বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকল পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের মধ্যেও জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।

সারা দেশের জনগণের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাগরণ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকল সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। একাত্তরে যেমন সকল ধর্ম-বর্ণের মানু্ষ একত্রিত হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল ঠিক তেমনি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য জাতি, ধর্ম-বর্ণ সকল শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

প্রকাশকাল: ১২ এপ্রিল ২০২২, একুশে

আরও পড়ুন..