- তাপস হালদার
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের উজ্জল নক্ষত্র। বাংলা ও বাঙালিকে তিনি বিশ্ব দরবারে মর্যদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশ,ভারত ও শ্রীলংকা এই তিনটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা একমাত্র তিনিই। এমন বিরল সম্মান আর কারো নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত-সংকলন গীতবিতান -এ স্বদেশ পর্যায়ের প্রথম গানটি হলো- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই গানের প্রথম দশ পংক্তি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ‘প্রথম ভাগ’ (প্রজাতন্ত্র) -এর ৪ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ।
‘আমার সোনার বাংলা’ একদিনে বাংলাদেশের সংগীত হয়ে যায় নি। আছে দীর্ঘ ইতিহাস।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছোট বেলা থেকেই ছিলেন রবীন্দ্র সাহিত্যের ভক্ত। প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে রবীন্দ্র নাথের কবিতা ও গান তাঁকে প্রেরণা দিত। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সংসদ সদস্যগণের সম্মানে বঙ্গবন্ধু কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরাই ছিলো মূল লক্ষ্য। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গানসহ লোকসংগীত পরিবেশিন করা হয়।অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করেন।
অধ্যাপক সনজীদা খাতুন ‘সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাই’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: ছাপ্পান্ন সালের কথা। ঢাকাতে কোনো সরকারী বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু প্রতিনিধি এসেছিলেন। তাদের জন্যে কার্জন হলে আয়োজিত সংস্কৃতি সন্ধ্যায় আমি গান গাইবার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। হঠাৎ একজন এসে খবর দিল, ‘আমার সোনার বাংলা গাইতে হবে, শেখ মুজিবুর রহমান এই গান খানি পশ্চিম পাকিস্তানের ডেলিগেটদের শোনাতে চান।’…কোনোমতে গানখানি গাওয়া হয়েছিল। তখন বুঝিনি, আজ বুঝি এটি কোনো বিছিন্ন ঘটনা ছিল না। সুপরিকল্পিতভাবেই এই গানখানি গাওয়ানো হয় সেদিন।’
১৯৬১ সালে কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করে পাকিস্তানী শাসক গোষ্টী।কিন্তু পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিগণ শাসকগোষ্টীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কবির জন্ম শতবার্ষিকী পালন করেন।আন্দোলনের প্রতিবাদে তৈরি হয় ছায়ানট। বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রতিষ্ঠিত করে ছায়ানট। এ আন্দোলনেও নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা করেন বঙ্গবন্ধু।অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচীতেও জাতীয় সংগীতের আদতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার রেওয়াজ চালু হয়।
১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করলে শিল্পী ও প্রগতিশীল মানুষের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুও একাত্মতা ঘোষণা করেন।আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা প্রদান কালে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুংদের পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না—আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হবেই।’
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীনতার ইস্তেহার ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সে জনসভার শুরুতে ‘ আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও জাতীয় সংগীত হিসেবে গানটি গাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানটি গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনুপ্রাণিত করা হয়।
১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকান্ডের পরনেয় খুনী জিয়া-মোশতাক সরকার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রথম উদ্যোগ গ্রহন করে। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির পদে বসেই জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড.দ্বীন মুহাম্মদকে সভাপতি করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ থেকে যেকোনো একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেন।কিন্তু দ্রুতই মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হলে সে সুপারিশ আর আলোর মুখ দেখেনি।
মোশতাকের পর ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রধান খলনায়ক, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তার নির্দেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতের জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন কবির লেখা গান জাতীয় সংগীত হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ উদ্বিগ্ন। এই গান আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’
চিঠিতে আরো বলেন, ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক। প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি করে। এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগও থমকে যায়।
২০০১ সালে জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন জামায়াতের দুই হেভিওয়েট নেতা শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। সেখানে তারা বলেন, ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন।’
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িতপ্রাাপ্ত মন্ত্রী তারই বোন খুরশীদ জাহান হককে পাঠান।মন্ত্রী বিষয়টি ‘অতি গুরত্বপূর্ণ’ বলে সচিবের কাছে পাঠালে,সচিব জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে এড়িয়ে যান। এরপর চিঠি চালাচালির এক পর্যায়ে বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয় নি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা বারবার জাতীয় সংগীতকে পরিবর্তণ করার চেষ্টা করেছে। অথচ রবীন্দ্র নাথ ছিলেন সকল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তাঁর লেখায় স্পস্ট করে বলেছেন, ‘আমি হিন্দু’ ‘আমি মুসলমান’ এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। কিন্তু ‘আমি মানুষ’ এ কথা কাহাকেও বলতে শুনি না। যারা মানুষ নয় তারা হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক,তাদের দিয়ে জগতের কোন লাভ নেই।’এটাই ছিল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের অসাম্প্রদায়িকতার মূল দর্শণ।তিনি কোন ধর্ম কিংবা বিশেষ শ্রেণীর নয়,তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালির সম্পদ।
গত বছর (২০২১ সালে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ বাঙালির অনন্ত প্রেরণার উৎস।কবিগুরু বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের একান্ত আপনজন। জীবনের প্রতিটি সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের চেতনাকে আন্দোলিত করে।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কবিগুরুর কবিতা,গান আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। বাঙালির মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে তাঁর অবদান চির ভাস্কর,চির অমলিন।তাকেঁ কখনো বাংলা ও বাঙালি থেকে বিছিন্ন করা যাবে না। তিনি আছেন প্রতিটি বাঙালির অস্তিত্ব জুড়ে।
২৫ বৈশাখ (৭ মে) কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের জন্মদিন।তিনি ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (১৮৬১ সালের ৭ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।বাঙালির এই মহামানবের শুভ জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও হাজারো প্রণতি জানাই।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
প্রকাশকাল: ০৭ মে ২০২২, বাহান্ন নিউজ।