- মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন আহমেদ
আগস্ট মাস শোকের মাস—ষড়যন্ত্রের মাস— বাঙালির হৃদয়ের রক্তক্ষরণে বেদনাবিধুর মাস। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য, বাঙালির মুক্তির জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মুক্তির দূত হিসেবে মুজিব নামের এই অগ্নিপুরুষের নেতৃত্বে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন বাংলার সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষের জন্য। তিনি জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কাটিয়েছেন লড়াই, সংগ্রাম ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হওয়ার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে মাত্র সাড়ে তিন বছরে পুনর্গঠন করে তিনি উন্নয়নের সব পাটাতন (Foundation) স্থাপন করে দেশকে যখন উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ও অসাম্প্রদায়িকতাকে ধ্বংস করে, এদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাঙালির প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং তাদের পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ ১৮ জনকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড শুধু গুটি কয়েক বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার দ্বারা করা সম্ভব নয়। এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। জাতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর অনেকগুলো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আল্লাহর অসীম রহমতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারীরা কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিচারের পথ রুদ্ধ করে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে খুনিদের পুরস্কৃত করে। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করে, এমনকি স্বাধীনতার ইতিহাসকেও বিকৃত করে তারা আবার সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত প্রদর্শন করে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের গাড়িতে বাংলার লাল-সবুজের পতাকা তুলে দেয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণ করে অসীম সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করে সঠিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের অদম্য অগ্রযাত্রায়। তিনি করোনাসহ সব দুর্যোগে ভরসার স্থল—আস্থার প্রতীক।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আগে ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যাচার (Propaganda) ছড়িয়ে ক্ষেত্র (Plot) তৈরি করতে থাকে। তারা জাতীয়করণের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা ছড়ায়। অথচ ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বহুজাতিক কোম্পানি, শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে নামমাত্র মূল্যে বঙ্গবন্ধু পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র রাষ্ট্রীয়করণ করেন। এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র হচ্ছে তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাসটিলা। বর্তমানে এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র দেশের মোট উত্পাদনের ৩১ দশমিক ৪৪ ভাগ সরবরাহ করে, যার বাজারমূল্য কয়েক লক্ষ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার করা হয়েছে। অথচ শেখ কামাল তার মাত্র ২৬ বছরের জীবনে একদিকে মেধাবী ছাত্র, প্রথম শ্রেণির ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়াসংগঠক, আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা, সংগীত ও অভিনয়শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ঢাকা থিয়েটার এবং স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা, ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক, সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত, সদালাপী ও সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষ। জাতির পিতার সন্তান হয়েও তিনি কোনোদিন অহংকারী ছিলেন না বরং তিনি আচার-আচরণে ছিলেন অতি বিনয়ী ও সহজ-সরল।
তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য একটি কমিশন গঠন আজ সময়ের দাবি। এদেশের প্রচলিত আইনেই তা করা সম্ভব। তাছাড়া জাতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ লক্ষ করছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা খুনি, যারা যুদ্ধাপরাধী ও জাতির পিতার হত্যাকারী তাদের সব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার বাইরে রাখতে হবে। ভিয়েতনাম, জার্মানিসহ অনেক দেশে এ ধরনের বিধান রয়েছে। এ মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা— বঙ্গবন্ধুর যেসব খুনি এখনো বিদেশে পলাতক রয়েছে তাদের অবিলম্বে দেশে এনে দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর করা। সব ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে আমাদের সন্তান— পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদ রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী আস্থার প্রতীক ও ভরসাস্থল। তার নেতৃত্বে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশ আরো দ্রুতগতিতে উন্নয়নের অদম্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাবে। বাঙালি হূদয়ে নতুনভাবে আর রক্তক্ষরণ যুক্ত হবে না। বেদনাবিধুর আগস্টে জাতির এ প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতিসচিব