- তাপস হালদার
মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। নারী-পুরুষ, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে এসেছে এই মহান স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সংবিধানেও নারী-পুরুষের কোনও বিভেদ করা হয়নি। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ সাংবিধানিকভাবেই নারী-পুরুষে বৈষম্য করার কোনও সুযোগ নেই।
কিন্তু এখনও বাংলাদেশে এক শ্রেণীর ‘মৌলবাদী’ আছে যারা নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করে তাদের কৃতদাস মনে করে। নারীর উপর ফতোয়া জারি করে যে, তারা কী করতে পারবে, কী পারবে না। তারা চায় না নারীরা স্বাধীনতা পাক, সম্মান পাক, সমাজে নারীরা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকুক। মেয়েরা কী পরবে, সেটা তারাই ঠিক যেন ঠিক করে দিবে। রাস্তা-ঘাটে কোনও নারী শ্লীলতাহানির শিকার হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষারোপ না করে, নারীর পোশাককেই দোষারোপ করা হয়। কিন্তু একজন নারী মা, বোন কিংবা স্ত্রী। তাদের অধিকার, মর্যাদা রক্ষা করা একজন পুরুষেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।
গত ২ এপ্রিল ফার্মগেট এলাকায় একজন নারীকে টিপ পরা নিয়ে কটূক্তি করেছে পুলিশ। ঘটনার বর্ণনায় তেঁজগাও কলেজের শিক্ষিকা ড. লতা সমাদ্দার বলছেন, ‘শনিবার সকালে তিনি তার বাসা থেকে কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। আনন্দ সিনেমা হলের সামনে থেকে হেঁটে যখন তিনি তেজগাঁও কলেজের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন সেজান পয়েন্টের দিকে তিনি শুনতে পান, ‘টিপ পরছোস ক্যান’ বলে একটা গালি। আমি ঠিক পেছনে তাকিয়ে দেখি, একজন পুলিশ একটা বাইকের ওপর বসে আছে। আমি তার প্রতিবাদ করলে সে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে ‘
’তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে সে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমার শরীরের ওপর দিয়ে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি সটকে যাই, কিন্তু তার বাইকের চাকা আমার পায়ে লাগে। আমি আহত হই।’
ড. লতা সমাদ্দার এ বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় অভিযোগ করেন।তারপর থেকে প্রথমে স্যোসাল মিডিয়া ও পরবর্তীতে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তোলেন।
ফেসবুকে নারীরা টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এমনকি অনেক পুরুষেরাও টিপ পরে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। শুধু ফেসবুক নয়, নারী অধিকার নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিবৃতি এবং প্রতিবাদ সমাবেশ করেও লতা সমাদ্দারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছেন। সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করে দোষী ব্যক্তির শাস্তি দাবী করেছেন।মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপুমনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে টিপ পরিহিত সাতটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন ‘আমি মানুষ, আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি নারী।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে এ ঘটনা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এ ধরনের ঘটনা বাংলার আবহমানকালের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার ও নারীর সাজ এবং পোশাকের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস। জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ প্রশাসনের কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত এই ন্যক্কারজনক ঘটনা সম্মিলিতভাবে এখনই প্রতিহত করা দরকার।
ড. লতা সমাদ্দারকে নিপীড়নকারী পুলিশ সদস্য তিনটি অপরাধ করেছেন।প্রথমত: নারী বিদ্বেষী মনোভাব দেখিয়ে নারীদেরকে অপমান করেছেন, দ্বিতীয়ত: একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীকে ইভটিজিং করে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা প্রদর্শন করেছেন এবং তৃতীয়ত: একজন আইনের রক্ষক হয়ে আইন ভঙ্গ করেছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তি একজন নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ব্যক্তি ও শিক্ষক। আর নিপীড়নকারী রাষ্ট্রের একজন পোশাকধারী কর্মচারী। রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন তাদের শাস্তিটাও দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ পুলিশ অনেক জনহিতকর কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা মানবিক পুলিশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্যক্তির দায় বাহিনীর উপর বর্তায় না। বরং সঠিক ব্যবস্থা নিয়ে বাহিনীকে আরো জনবান্ধব হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে দোষী ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে। রাষ্ট্রের উচিত এমন শাস্তি নিশ্চিত করা যাতে করে ভবিষ্যতেও কেউ নারীর প্রতি এমন নিপীড়নের চিন্তাও করতে না পারে।
এমন নারী বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীরা রাষ্ট্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরা তেঁতুল হুজুরের বংশধর, স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রেত্মাতা। এরা বাংলাদেশকে ধারণ করে না, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে মানে না। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারী নেতৃত্বকে হারাম বলে। এরা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এদের কোনও ঠাঁই নাই।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।